আজ || সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
শিরোনাম :
 

তালায় বদলে যাওয়া স্কুলের গল্প……


বয়ঃসন্ধি-কালীন স্বাস্থ্যসেবা,কমেছে স্কুলছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার

গাজী জাহিদুর রহমান:

‘আগে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশের মতো ছাত্রী উপস্থিত হতো। এখন ছাত্রীর উপস্থিতি ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সামান্যের যে বিশালতা আমরাও আগে বুঝতে পারিনি। বলতে পারেন চমকে গেছি।’ তালা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার খলিষখালী শৈব বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কল্যাণী দে এমন মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ওয়াশ প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের স্বাস্থ্যকর মাসিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করায় এই অবাক করা সাফল্য এসেছে। শুধু উপস্থিতির হার বেড়েছে তেমনটি কিন্তু নয়। এখন স্কুলের রেজাল্টেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েরা মাসিকের সময় স্কুলে আসতো না। এতে তার পড়ার গ্যাপ তৈরি হতো। সেই গ্যাপ পূরণ না হতেই পরের মাসে আবার স্কুলে আসা বন্ধ। এভাবে মেয়েরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো। এখন যেহেতু স্কুল কামাই করার সুযোগ নেই, তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে।’
তিনি আরও বলেন, আগে দেখা যেত মেয়েরা স্কুলে আসার পরও শারীরিক সমস্যার কথা বলে বাড়ি চলে যেতো। অনেক সময় কেউ কেউ হয়তো ফাঁকি দেয়ার জন্যও বলতো। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকতো না। এখন কিন্তু স্কুলে তাদের সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্লাসে একটি ভলান্টিয়ার টিম রয়েছে। আবার একজন শিক্ষিকা রয়েছে যার কাছে জমা থাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও অন্য ফার্স্ট এইড। মেয়েরা স্কুলে এসে হঠাৎ মাসিক হলে সঙ্গে সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে পরবর্তী ক্লাসগুলো করে বাড়ি ফিরছে। আবার পরদিনও নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিতে পারছে।’
ঐ স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী রিফাত ইয়াসমিন রিয়া, নবম শ্রেণির চৈতি মণ্ডল, ৮ম শ্রেণির সাদিয়া খাতুনসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বড় আপুদের কাছে শুনেছি তারা স্কুলে এসে অনেক সমস্যায় পড়তো। কিন্তু আমরা স্কুল থেকে সব ধরনের সহায়তা পাই। কোনও সমস্যা হলে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু পেয়ে যাই।
স্কুলের অভিভাবক সদস্য চায়না রানী নাথ জানান, নারী শিক্ষার জন্য এটা খুবই জরুরি। দেশের সব স্কুলে এই ব্যবস্থা করা গেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা পাওয়া যাবে।
অভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে জাগরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হাফিজুল ইসলামের কাছ থেকেও। তিনি বলেন, উত্তরণের ওয়াশ প্রকল্পের সহায়তায় স্কুলের ছাত্রীদের বয়ঃসন্ধি-কালীন যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। এরপর থেকে উপস্থিতির হার বেড়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি যে পরিবর্তন এসেছে তা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা। তারা এখন এটাকে আর কোনও রোগ বা সমস্যা মনে করে না বা এটাকে নিয়ে রাখঢাক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তারা খোলামেলা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে, এমনকি পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও।


উত্তরণের ওয়াই ওয়াশ (নিউ এরিয়া ওয়াশ এসডিজি ওয়াই এসপি বাংলাদেশ) প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী হাসিনা পারভীন জানান, তালা উপজেলার ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কর্ণার তৈরি করা হয়েছে ন্যাপকিন। এতে প্রায় ২ হাজার ছাত্রীর মাসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত হচ্ছে। এছাড়া একই প্রকল্পের আওতায় তিন ইউনিয়নের ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩১৫০ জন শিক্ষার্থীকে ওয়াশ তথা পানি, পায়খানা, হাত ধোয়া ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন করা হচ্ছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় স্কুল ক্যাম্পেইন, শিক্ষকদের সাথে ম্যানেজিং কমিটির মিটিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
তালা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আতিয়ার রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধি-কালীন যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার কমেছে। বিশেষ করে ছাত্রীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যাপকিন কর্ণার সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংকোচ দূর হচ্ছে। লেখাপড়ার মানও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তালা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রাজীব সরদার জানান, বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্ধেক শতাংশ নারী। এদের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে আমাদের পথচলায় হোঁচট খেতে হবে। বিভিন্ন হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ওয়াশ তথা পানি, পায়খানা, হাত ধোয়া ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে উত্তরণের ওয়াশ প্রকল্প। উক্ত প্রকল্পের আওতায় ছাত্রীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যাপকিন কর্ণার তৈরি ভাল উদ্যোগ বলে মনে করেন তিনি।


Top